ধরা যাক, আপনি বিংশ শতাব্দির আরবি ভাষার একজন ছাত্র/ছাত্রী। আপনি ক্লাসিক্যাল আরবি (ফুসহাহ) অথবা আধুনিক ক্লাসিক্যাল লিখিত আরবির বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। তো, আপনি চিন্তা করলেন যে, আপনি কুরআনের একটি আয়াতের বিশদ ব্যাখ্যা জানতে চান। আপনি ‘তাফসিরে তাবারি’ খুললেন এবং আপনার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নিলেন। চমৎকার, তাইনা? আপনি ২০১৯ সালের একজন ছাত্র হয়েও ৮৮৩ সনে লিখিত কুরআনের ভাষ্য ‘তাফসিরে তাবারি’ পড়ে বুঝতে পারেন! মানুষ আধুনিক আরবি শিখেও যে প্রায় ১০০০ বছরের বেশি পুরোনো লেখা বুঝতে পারে, তা সত্যিই অসাধারণ। আরবি যে এত দীর্ঘ সময়ে অপরিবর্তিত থেকেছে, তা অন্যান্য ভাষা থেকে এর উচ্চতর অবস্থানকেই পাকাপোক্ত করে।

বিষয়টি কতটা দারুণ তা পাশের চিত্রের ইংরেজি লেখাটির দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে। এটি প্রায় একই সময়ে লেখা (৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের আশপাশে)। নিচের উদ্ধৃতাংশটি Beowulf নামক কবিতা থেকে নেওয়া প্রাচীন ইংরেজির একটি অংশবিশেষ:

Hƿæt! ƿē Gār-Dena in ġeār-dagum,
þēod-cyninga, þrym ġefrūnon,
hū ðā æþelingas ellen fremedon.
Oft Scyld Scēfing sceaþena þrēatum,

~৮ম শতাব্দির প্রাচীন ইংরেজি কবিতা Beowulf এর অংশবিশেষ 

আপনি যদি দীর্ঘক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে কিছু কিছু শব্দের সংযোগ খুঁজে পেলে পেতেও পারেন  (বর্তমান ইংরেজির সাথে)।

ইংরেজি ভাষা এত ব্যাপকভাবে বদলে গেল কেনো?

স্বরধ্বনির বিশাল পরিবর্তনের কারণে ইংরেজি ভাষার চেহারা এবং উচ্চারণ ব্যাপক ভিন্নতা পেয়েছে। এর প্রভাবে ভাষার উচ্চারণ এবং ব্যাকরণ বিরাট রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়, যার ফলশ্রুতিতে ইংরেজির সকল মধ্য স্বরধ্বনির উচ্চারণ পাল্টে যায়। কিছু কিছু ব্যাঞ্জণধ্বনিও এই পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়। ‘meat’ এর উচ্চারণ ‘mat’ এর মত হয়, ‘bite’ এর উচ্চারণ ‘beat’ এর মত শোনায়, এবং ‘out’ শব্দটি ‘oot’ এর মত করে ঊচ্চারিত হতে থাকে। আপনি যদি ব্যাকরণের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে চান, তাহলে ১৭ শতাব্দিতে লিখিত Shakespeare এর “Romeo and Juliet” এর নিম্নোক্ত লাইনটির দিকে নজর দিলেই যথেষ্ট।

“O Romeo, Romeo, wherefore art thou Romeo?”

এই লাইনের মানে কি মনে হয় আপনার কাছে? এই বাক্যটির অর্থ এই নয় যে, “তুমি কোথায় রোমিও?”, যেমনটি অধিকাংশ মানুষ ধারণা করবে। ‘Wherefore’ এর অর্থ হল, “কি উদ্দেশ্যে?” তাই এই লাইনটির খসড়া মানে দাঁড়ায়, “ও রোমিও, রোমিও, তোমার রোমিও হওয়ার উদ্দেশ্য কি?” অথবা “তুমি কেনো রোমিও?”

এটি অজস্র উদাহরণের মাঝে একটি মাত্র। কিন্তু আমরা যদি ইংরেজির সাথে অন্যান্য ভাষার তুলনা করি, তাহলে একইরকম একটি ধারা দেখতে পাবো। আর তা হল যে, সেগুলো পরিবর্তনশীল (প্রতিনিয়ত তাদের মূলপাঠ থেকে ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণে পরিবর্তিত হতে থাকে। অনেক ভাষা তো বিলুপ্তই হয়ে যায়)।

সুতরাং, কোন কারণে আরবি ভাষা অক্ষুণ্ন রয়েছে? এর সুনির্দিষ্ট এবং মৌলিক উত্তর হল: আল কুরআন।

আরেকটি বড় কারণ হল: মুহাম্মাদ (সা:) এর কাছে কুরআন নাযিল হওয়ার সময় (৬১০-৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) আরবির ভিন্ন ভিন্ন উপভাষা প্রচলিত ছিল। কুরআন এসব উপভাষাতেও নাযিল হয়। কিন্তু, ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান(রাঃ) এর খিলাফতকালে, ৭ম খ্রিষ্টাব্দে, শুধুমাত্র কুরআইশদের উপভাষায় কুরআন সংকলিত হয়। সে সময় থেকে নিয়ে পরবর্তীতে কুরআনের আরবি সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে যায়; সিরিয়া, ইরাক, আফ্রিকা এবং সুদূর স্পেনেও।

C. Walter Hodges (সূত্র: Wikimedia Commons)

উমাইয়্যা খিলাফতের সময়কাল (৬৬১-৭৫০ খ্রিষ্টাব্দ)

IIRT Arabic Intensive - দুই বছর মেয়াদী অনলাইন ভিত্তিক আরবি ভাষা শিক্ষা প্রোগ্রাম।

বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন www.arabic.iirt.info

নতুন গড়ে ওঠা এই ইসলামি সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা ছিল আরবি। কিন্তু বহুসংখ্যক অনারবরা যেহেতু তা শিখছিলো, তাই তারা (অনারবরা) কুরআন পাঠের ক্ষেত্রে নানাবিধ ভুল করতে থাকে। তাই আরবরা কুরআনের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে। একথা ভেবে তারা নুকতা এবং স্বরধ্বনি চিহ্নের প্রচলন করে, যাতে করে বিশুদ্ধভাবে আরবি ভাষা, এবং উপর্যুপুরি কুরআনকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করে পড়া হয়। আজোবধি অনারবরা নিরন্তর তাদের আরবি বর্ণমালার উচ্চারণ বিশুদ্ধ করার প্রয়াস চালিয়েই যাচ্ছেন।

“৭৫০ সালে খেলাফত”। উইলিয়াম আর শেফার্ডের  “The Historical Atlas” থেকে, ১৯২৬

আল খাওয়ারিজমির “আল কিতাব আল মুহতাসার ফি হিসাব আল গাবার ওয়া মুকাবালা” থেকে নেওয়া যা থেকে বর্তমান বীজগণিত (algebra) নামটি এসেছে। (সূত্র: Wikimedia Commons)

আব্বাসীয় খিলাফতের সময়কাল (৭৫০-১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ)

এতদমধ্যে ইসলামি সম্রাজ্য তার “সোনালী যুগে” এসে উপনীত হয়েছিল। জ্ঞানচর্চা, বিজ্ঞান এবং শিল্পের সকল ক্ষেত্রে এক বিপ্লব সাধিত হয়। আরবি ছিল জ্ঞানীগুনীদের ভাষা। জ্ঞানবিজ্ঞানের কিতাবগুলো বিভিন্ন ভাষা থেকে আরবিতে অনূদিত হতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, খলিফা মনসুর আদেশ দেন যে, সকল সাহিত্যকে যেন আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তার এই আদেশের ফলে গ্রিক, সিরিয়াক এবং ফারসি ভাষায় লিখিত কিতাবগুলোকে আরবিতে অনুবাদ করা হয়। সিরিয়াক বা ফারসির কিতাবগুলো আসলে ছিল গ্রিক এবং সংস্কৃত ভাষা থেকে অনূদিত।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, আরবি ভাষাকে কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা না হলে অনেক ক্লাসিক্যাল সাহিত্য এবং কিতাব বিলীন হয়ে যেত। উদাহরণস্বরূপ, এরিস্টটলের বেশিরভাগ কাজগুলো আরবি অনুবাদ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে (মূল গ্রন্থগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে)

আরবির উপভাষাগুলো ততদিনে সিরিয়া, ইরাক এবং মদিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কিন্তু মুসলিমরা বরাবরই কুরআন এবং হাদীসকে উচ্চাসনে সমাসীন রেখেছিল। অর্থাৎ, শিক্ষা এবং দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রূপই ছিল আরবির প্রকৃত এবং বিশুদ্ধরূপ যেটিকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল।

আরবি ভাষা যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে:

১৪ শতাব্দির পরে ইসলামী সাম্রাজ্যে মারাত্মক ফাটল ধরে এবং তা ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে যায়। সেটি ছোট ছোট রাজ্যে ভাগ হয়ে যায় এবং বড় বড় অংশগুলো বিদেশী শাসকদের হাতে চলে যায়। ইবনে খালদুন বলেনঃ “যখন দাইলাম এবং তাদের পরে সালজুক, যানিতাহ ও পশ্চিমে বারবারদের মত অনারবরা মুসলিম বিশ্বের শাসক বনে যায় এবং সিংহাসনে আসীন হয়, তখন আরবি ভাষার মধ্যে প্রচুর ভেজালের সংমিশ্রণ ঘটে। এটি (আরবি) সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেত, যদি মুসলিমদের কুরআন এবং সুন্নাহ হেফাযত করার চেতনা না থাকত। ফলশ্রুতিতে এটিই আরবি ভাষাকে সংরক্ষণ করে।” (উৎস: ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দামাহ এর ৪৭৭ নং পৃষ্ঠা, ফ্রানয রোজেনথালের অনুবাদ থেকে নেওয়া)

হুনায়ুন ইবনে ইসহাকের মতানুসারে ১২০০ সনে অঙ্কিত মানুষের চোখের ছবি। (সূত্র: Wikimedia Commons)

এরপরে মোঙ্গলরা (মুসলিম বিশ্বে) হামলা করে বসে। ইবনে খালদুন বলেন, “কিন্তু যখন অমুসলিম তাতার এবং মোঙ্গলরা পূর্বদিকের শাসক বনে যায়, তখন এই আরবি ভাষার অনুকূলে থাকা বিষয়টি (অর্থাৎ, মুসলিমদের কুরআন এবং সুন্নাহকে হেফাযত করার প্রচেষ্টা) খতম হয়ে যায়। আরবি ভাষা তখন পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। মুসলিম রাজ্যগুলো যেমনঃ ইরাক, খুরাসান এবং ফারিস (দক্ষিণ ইরান), পূর্ব এবং পশ্চিম ভারত, ট্রানসোযিয়ানা, উত্তরের দেশগুলো এবং বাইযেনটাইন (আনাতোলিয়া) এর কোথাও আরবির কোনো অস্তিত্বই আর বাকি থাকেনা। সামান্য কিছু অবশিষ্টাংশ বাদে আরবি কাব্য এবং কথোপকথনের সিলসিলা (উসলুব) সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়। দিকনির্দেশনা (যেই নগণ্য আরবি জানা যায়) হল এমন একটি কারিগরি বিষয় যা আরবদের বিজ্ঞান থেকে জানা যায় এবং তাদের কথোপকথন থেকে মুখস্ত করে মনে রাখা হয়। এটি তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে যাদেরকে আল্লাহ নিজের তরফ থেকে এর জ্ঞান প্রদান করেছেন। আরবির মূল ভাষা মিশর, সিরিয়া এবং পশ্চিমে বহাল থাকে। কারণ ইসলাম সেখানে আজো আছে এবং এটি (আরবি ভাষা) সেখানে অত্যাবশ্যকীয়। তথাপি, আরবি সেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু ইরাকের কিছু প্রদেশ এবং এর পূর্বের দেশগুলোতে আরবির কোনো অস্তিত্বই আর বাকি থাকেনি। এমনকি বিজ্ঞানের কিতাবগুলো অনারব (ফারসি) ভাষাতে লিখিত হতে থাকে এবং ক্লাসগুলোতে আরবি শেখানোর ক্ষেত্রে ফারসি নির্দেশনার মাধ্যমে শেখানোর পরম্পরা চালু হয়। (উৎস: ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দামাহ এর ৪৭৭-৪৭৮ নং পৃষ্ঠা, ফ্রানয রোজেনথালের অনুবাদ থেকে নেওয়া)

সবশেষে, গ্রানাডার পতনের পরে স্পেনে আরব ইসলামি সাম্রাজ্যের (যা মুসলিম বিশ্বের কাছে আন্দালুস নামে পরিচিত) অবসান ঘটে এবং আরবি ভাষা স্থলাভিষিক্ত হয় (অন্য ভাষার দ্বারা)। শুরুর দিকে ওসমানি সাম্রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা আরবি হলেও পরবর্তীতে (১২৯৯-১৯২২) তা পরিবর্তন করে তুর্কি করা হয়।

এতদসত্ত্বেও আরবি ভাষা সমস্ত চড়াই উৎরাই পারি দিয়ে টিকে রয়েছে। কারণ এমন একটি দূর্গ এর কাছে রয়েছে যেখানে সে সমস্ত দুর্যোগের সময় ফিরে আসতে পারে।

ক্লাসিক্যাল আরবি ভাষা সবসময়ই কুরআনের মজলিস, মসজিদ, স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হত। এটিকে ফিকহ, তাফসির এবং হাদিসের মত ইসলামি জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত। এসবের উচ্চারণগুলো বিশুদ্ধভাবে ঠিক তেমনভাবে শেখানো হত, যেমননিভাবে রাসুল (সা:) এর সময়ে তা উচ্চারিত হত।

আল্লাহ তা’আলা, যিনি কখনোই নিজের ওয়াদা ভঙ্গ করেননা, তিনি পবিত্র কুরআনে বলেন, “নিশ্চই আমি এই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।” (সূরা হিজর: ৯)

কুরআন কখনোই পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষিত হতে পারতোনা যদিনা আরবি ভাষা, যেটিতে এটি নাযিল হয়েছে তা সংরক্ষিত না থাকত। অন্যথায়, একজন তিলাওয়াতকারী এর অর্থ পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারতোনা। এটি অবোধ্য থেকে যেত। আর আমরা (আল্লাহর) এই ওয়াদার সত্যতা দেখতে পাই ইতিহাসের পাতায় পাতায়।


উৎস: IOU Insights (10th issue)

অনুবাদক: মিনহাজ মুক্তাদির

অনুবাদ কপিরাইট © IIRT

মতামত

comments

IIRT Arabic Intensive - দুই বছর মেয়াদী অনলাইন ভিত্তিক আরবি ভাষা শিক্ষা প্রোগ্রাম।

বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন www.arabic.iirt.info